বিসিএস বা সরকারী চাকুরীর জন্য যারা পড়াশোনা করছেন তারা “ধর্মঠাকুর” নামটির সাথে পরিচিত হবার কথা।
আমিও মূলত নামটি পেয়েছি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা করার সময়। তাই এই ধর্মঠাকুর কে নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে তার সম্পর্কিত কিছু ইনফর্মেশন পেয়ে গেলাম তাই তা সবার সাথে শেয়ার করছি।
ধর্মঠাকুর” বাংলার জনপদ সমাজে লৌকিক দেবতাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পূজিত ও আলোচিত। মৃত্যুর দেবতা যমের মত ধর্মঠাকুর ও “ধর্মরাজ” নামে পরিচিত। বীরভূম জেলার ইটাগড়িয়া পল্লীর ও অপর দু এক স্থানে ধর্মঠাকুরের বিশেষ উৎসবে যমরাজের পট আনুষ্ঠানিক ভাবে মন্দিরে বিগ্রহের পাশে স্থাপন করা হয় ও যমরাজের মাহাত্ম ও গাওয়া হয়। তবে স্থানভেদে তিনি চাঁদ রায়, যাত্রাসিদ্ধি রায়, ক্ষুদি রায়, সুন্দর রায়, বাঁকা রায়, কালু রায়, বৃহদাক্ষ,মতিলাল, পুরন্দর নামেও পরিচিত।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ” ডিসকভারী অফ লিভিং বুদ্ধিজম অফ বেংগল” নিবন্ধে ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ দেবতা আখ্যায়িত করেছেন। যদিওতিনি এই ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। মূলত বৌদ্ধ পূর্ণিমায় ধর্ম ধর্মঠাকুরের বিশেষ পূজা পার্বণ অনুষ্ঠিত হওয়া এবং ধর্মঠাকুরের পূজায় নৈবেদ্য-ফুল দেওয়া এবং পূজাচারে তন্রযানী বৌদ্ধদের পূজাচারে মিল দেখে গবেষকরা ধারণা করেন যে ধর্মঠাকুরের বা তাঁর পূজাচারের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের কিছু সম্পর্ক হয়ত আছে।
অনেক গবেষক ধারণা করেন যে, ব্রাক্ষণ্য ধর্মের প্রভাবে, ব্রাক্ষণ ও ব্রাক্ষণশাসিত সমাজের উচ্চবর্ণের ব্যক্তিদের স্বধর্মী অনুন্নত সমাজের প্রতি অবহেলা ও অমর্যাদা, শাস্ত্রীয় দেবতাদের পূজার অধিকার থেকে বঞ্ছিত করা প্রভৃতি কারনে নিম্ন শ্রেনীর অনেকেই বৌদ্ধধর্মের উদার আশ্রয়ে চলে যেতে থাকেন। তাদের এই মনোভাব লক্ষ্য করে অনুন্নতদের কোন কোন সমাজপতি বা ধর্মনেতা উদার ভাবাপন্ন ধর্মসমাজের বা ধর্মের প্রবর্তন করেন। ধর্মঠাকুর বা এজাতীয় লৌকিক দেবতার পূজার প্রভাব বিস্তারে নিম্নশ্রেনীর ব্যক্তিদের আর অন্য ধর্মে চলে যাবার প্রবণতা থাকেনা। “তারকেশ্বরের শিবতত্ত্ব” পুথিতে এই ব্যপারে আভাস পাওয়া যায়, ঐ পুথিতে লিখিত আছেঃ
” বহু দেব বহু মঠ না হয় কথন। নীচ জাতি গৃহে দেখ ধর্ম সনাতন
বৌদ্ধধর্ম বৌদ্ধ চর্চা করিতে নির্মুল। এতাদৃশ অনুষ্ঠান করে সাধুকুল “
পশ্চিমবঙ্গের রাঢ়দেশে এই পূজার প্রাধান্য ও আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তাই এটি ধারনা করা হয় ধর্মঠাকুরের পূজার উৎপত্তি স্থান উক্ত অঞ্চল বীরভূমে ধর্মঠাকুরের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পূজাপল্লী দুটির নাম যথাক্রমে “সিজেকড ডাং” এবং “বড় সাংড়া”– নাম থেকে আন্দাজ করা যায় এটি আদিম আর এদেশবাসীকোন আর্যেতর জাতির ভাষা থেকে উদ্ভুত।
তবে অনেকে অনুমান করেন ডোম জাতীয় রামাই পন্ডিত এর প্রথম প্রচারক ও প্রবর্তক। রামাই পন্ডিতের খন্ড খন্ড কাব্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিস্কার করেন।রামাই পন্ডিতের কাল সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত আছে, কোন কোন গবেষক মন্তব্য করেছেন তিনি খ্রিঃ ১০০০ সনে হতে খ্রিঃ ১৫০০ সনের মধ্যে বিদ্যমান ছিলেন।
ময়ূরভট্ট ধর্মমংগল ধারার প্রথম কবি এবং তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম হাকন্দপূরান । তাছাড়া খেলারামের ধর্মমঙ্গল ও প্রাচীন।
ধর্মঠাকুরের পূজার প্রাধান্য কাল পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত বহু ধর্মমঙ্গলের কবিদের রচনা পাওয়া গিয়েছে, মুদ্রিতও হয়েছে , তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রূপরাম,মানিক গাঙ্গুলী, ক্ষেমানন্দ, রামদাস, সহদেব প্রভৃতি। তাদের রচিত কয়েকটি মঙ্গলকাব্য এত উচ্চস্তরের যে সেগুলো বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী ও অমূল্য সম্পদ হিসেবে স্বীকার করতে হয়।কোন কোন ধর্মমংগলে পাল যুগের ইতিহাস পাওয়া যায়।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছাড়াও আরো অনেক মনীষী যেমন শ্রী সনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীসুকুমার সেন, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, তুষার চট্টোপাধ্যায়, অমলেন্দু মিত্র ও লোক সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক “ধর্মঠাকুর” সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
অধ্যাপক শ্রীসুকুমার সেন ধর্মঠাকুর কে মিশ্রিত দেবতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ( বিনয় ঘোষের “পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি” গ্রন্থে)। তিনি বলেন “ধর্মদেবতার উৎপত্তি বহুমুখ। অর্থাৎ বিভিন্ন সূত্রে আগত দেবভাবনা ও দৈবচিন্তা মিশে গিয়ে এক হয়ে ধর্মঠাকুরে রূপ নিয়েছে” শ্রীসুকুমার সেনের এই অনুধাবনের পিছনে কারন ছিল, কারন ধর্মঠাকুরের পূজাচারে বেশকিছু বীভৎস আচার ছিল যা আদিম যুগীয় বা তান্রিক দেবতাদিতে বিদ্যমান ছিল, যদিও পরবর্তীকালে ধর্মঠাকুরের পূজাচার পরিবর্তিত হয়েছে।
ধর্মঠাকুরের বিগ্রহ মনুষ্য আকৃতির ও সৌম্য দর্শন তবে বহুস্থানে শিলাখন্ড বা মাটির ছোট ঢিপি তাঁর প্রতীক বা বিগ্রহ হিসেবে পূজিত হয়। যা আদিম যুগীয়বা সর্বদ্রব্যে ঐশীশক্তি আছে এই ধারনাকেই মনে করিয়ে দেয় তাছাড়া তাঁর যোদ্ধা বা অস্বারোহী মূর্তিও দেখা যায়।
ধর্মঠাকুরের মূর্তি বা প্রতীক বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে–যেমন
১।ধ্যানীবুদ্ধের অনুরুপ (চব্বিশপরগণা জেলার বহু স্থানে)
২। রাজবেশধারী
৩। পৌরাণিক দেবতার অনুরুপ
৪। মহাদেবের অনুরূপ (জটা ও ত্রিশুল বর্জিত)
৫। সাধারণ শিলাখন্ড প্রতীক যা ধর্মশীলা নামে পরিচিত
৬। মুন্ডমূর্তি, ঘটপ্রতীক বা পোড়ামাটির ঘোড়াপ্রতীক
তাঁর বিশেষ পূজা ও গাজন উৎসবে যে সকল বীভৎস আচার অনুষ্ঠানাদি দেখা যায় তাঁর কিছুটা বর্ননা করছি
বহু সংখ্যক কবুতর, হাঁস, পাঁঠা এমনকি শুকর বলি হয়, পূজায় বা উৎসব পার্বনে অংশগ্রহনকারী সেবক বা ভক্তরা প্রচুর পরিমানে মাদক সেবন করেন, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর নৃত্য, অংগে বানবিদ্ধ করা প্রভৃতি –যা আদিম যুগীয় ধর্মাচার হিসেবে মনে করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে ধর্মঠাকুর গৃহদেবতা হিসেবে পূজিত হননা।তিনি মূলত পল্লীগতভাবে বা গ্রাম মোড়লের তত্ত্বাবধানে বারোয়ারী আদর্শে পূজিত হন।
ধর্মঠাকুরের পূজায় কোন জাতিভেদ নেই তাই বহুস্থানে তাঁর পূজায় নিম্নশ্রেণীর ডোমকে পৌরহিত্য করতে দেখা যায়।তাছাড়া মধ্যযুগে রচিত ধর্মমংগল মংগলকাব্যে এই ডোমজাতির গুনাবলীই বেশী বর্ণিত হয়েছে। মূলত হাড়ি, ডোম, বাগদী বা অনুন্নত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদেরই এই পূজায় পৌরহিত্য করেন যদিও বর্তমানে শোত্রীয় বা শাকদ্বীপি ব্রাহ্মনেরা কোন কোন ধর্মঠাকুরের মন্দির বা থানে পৌরোহিত্য করেন কিন্তু সেক্ষেত্রে সেবায়েত বা দেয়াসীরা হন অনুন্নত সমাজের লোক।
কথিত আছে “ধর্মঠাকুর” হলেন সূর্যদেবতা, কারন সূর্যদেবতার মতই তিনি কুষ্ঠরোগ নিরাময়কারী আর তাঁর কৃপায় বন্ধ্যা নারী পুত্রবতী হন।
ধর্মঠাকুরের মন্দিরের জানালার গরাদে বা সংলগ্ন বৃক্ষের শাখায় ঢিল বেঁধে ভক্তরা মানত বা প্রার্থনা করেন। তাদের বিশ্বাস এরূপ ঢিল বেঁধে রাখলে ধর্মঠাকুরের লক্ষ্য পড়বে ও তিনি ভক্তের অভীষ্ট পূরণ করবেন। এই কারনে বা অভীষ্ট পূরনের জন্য কোন কোন ভক্ত ধর্মঠাকুরের মন্দির বা থানে পোড়ামাটির ক্ষুদ্রাকৃতির ঘোড়া উৎসর্গ করেন।
ধর্মঠাকুরেরজ পূজায় মহাকষ্টকর বিধান পালন কালে দুএকজন ভক্ত্যা মূর্ছিত হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়লে তাদের সসম্মানে মন্দিরের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়, স্বয়ং পুরোহিত তাদের সেবা করেন, ভক্তদের ধারনা এটি আসলে মূর্ছা নয়, স্বয়ং ধর্মঠাকুর ভর (অধিষ্ঠান ) করেছেন আর মূর্ছিত ভক্ত্যারা যা বলে থাকেন সে কথাগুলি ধর্মঠাকুরের প্রত্যাদেশ বলে মনে করেন।
পূজা শেষে পুরোহিত বিগ্রহের উপর ফুল রাখেন, ঢাক ঢোল বেজে উঠে, বিগ্রহ থেকে ফুল সহজে পড়ে গেলে মঙ্গল মনে করা হয়।
একটি ইনফরমেশন দিয়ে শেষ করি — কলকাতা শহর হবার আগে এর সেন্টারে ধর্মঠাকুরের পূজার একটি কেন্দ্র ছিল যে কারনে ওই স্থানের নাম হয় ধর্মতলা পরে অবশ্য রাস্তাটি “ধর্মতলা স্ট্রিট” ও বর্তমানে “লেলিন সরণি” নামকরন করা হয়েছে। তবে আদি কলকাতার ধর্মঠাকুর এখনো আছেন।
রাজা সূবোধ মল্লিক স্কোয়ারের উত্তরে তিনি “বাঁকা রায়” নামে পূজিত হন।
(বানান ভুল মার্জনীয়–চেক করতে পারিনি)
তথ্যসূত্রঃ ১. বাংলার লৌকিক দেবতা ( গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু)
ওম প্রকাশ চৌধুরী
সহকারী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক
ISM Cell
ওম প্রকাশ চৌধুরী
সহকারী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক
ISM Cell