প্রথম পর্বে বলেছিলাম রবীন্দ্রনাথের পিতা তাঁর বালক পুত্র রবীন্দ্রনাথের জন্য হাফ টিকেট কেটেছিলেন। তাঁরা দুজনেই ছিলেন প্রথম শ্রেণীর কামরার যাত্রী। কোলকাতা থেকে অমৃতসর যাত্রার পথে কোন এক স্টেশনে ট্রেনটি যখন থামে তখন টিকেট চেকার তাদের কামরায় এলেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ মহাশয় তাঁর জোব্বা থেকে একটি ফুল টিকেট আর একটি হাফ টিকেট বের করে টিকেট চেকারকে দিলেন। টিকেট চেকার মহাশয় হাফ টিকেটের যাত্রী রবী ঠাকুরের দিকে চেয়ে একটু অবাকই হলেন। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহের এই ছেলে মোটেই হাফ টিকেটের যাত্রী হতে পারেনা। মনে সংশয় নিয়ে টিকেট চেকার মহাশয় কামরা ত্যাগ করলেন।
কিছুক্ষণ পর টিকেট চেকার মহাশয় আবার আসলেন ঠাকুর মহাশয়ের কামরাতে এবার তিনি একা নন। সাথে আরেকজন টিকেট চেকার। ২য় টিকেট চেকার মহাশয় ও মহর্ষির কাছ থেকে টিকেট দুটো চেয়ে নিয়ে চেক করলেন।তাঁর চোখেও বিস্ময় হাফ টিকেটের যাত্রীটির দিকে চেয়ে।
২য় টিকেট চেকার ১ম টিকেট চেকারের সাথে কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ কি যেন কথাবার্তা বললেন।কিছুক্ষন পর তাঁরা দুজন-ই প্রস্থান করলেন।
কিছুক্ষণ পর, এবার খুব সম্ভবত স্টেশন মাস্টার মহাশয় মনেহয় নিজেই চলে এসেছেন। তিনিও টিকেট খানি হাতে নিয়ে বললেন “এই বালকটির বয়স কি বারো বছরের বেশী নয়?”
মহর্ষি এমনিতেই খুব বিরক্ত ছিলেন, এবার বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন “বয়স যদি বারোর বেশী হতো তবে তাঁর জন্য হাফ টিকেট কেটেছি কেন?
সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ ও উজ্জ্বল চেহারার রবীন্দ্রনাথ কে দেখে তিনি যে অনুর্ধ বারো বছরের বালক তা টিকেট চেকার ও স্টেশন মাস্টার মহাশয় বিশ্বাস করতে চাইলেননা।
যাইহোক, স্টেশন মাস্টার মহাশয় সরাসরি বলেই বসলেন “মহাশয় এই বালকটির জন্য আপনাকে পুরো ভাড়াই পরিশোধ করতে হবে”
রাগে, দুঃখে অসম্মানে মহর্ষি জ্বলে উঠলেন, মুহূর্তমাত্র কালবিলম্ব না করে তাঁর বাক্স থেকে একটি নোট বের করে স্টেশন মাস্টারের হাতে দিলেন।
স্টেশন মাস্টার ফুল টিকেটের রসিদ কেটে বাকী টাকা গুলো ফেরত দিলেন। সেই টাকা গুলো মুঠোর মধ্যে নিয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ট্রেনের কামরার জানালা দিয়ে বাইরে প্ল্যাটফর্মে ছুড়ে ফেলে দিলেন,টাকার নোট গুলো বাইরের বাতাসে উড়তে লাগল,আর কয়েনগুলো ঝনঝন করে প্ল্যাটফর্মে রেলের চাকার মতই গড়িয়ে চলল।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্টেশন মাস্টার মহাশয় হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন কি ভুল তিনি করেছেন আর কতখানি অন্যায় কাজই না করেছেন। লজ্জায় অপরাধীর মত মুখ নিচু করে কামরা থেকে তিনি নেমে গেলেন।
ঋষিতুল্য পিতৃদেবের চরিত্রের যে ছবি বালক রবীন্দ্রনাথ ট্রেনের কামরায় বসে দেখলেন তা তাঁর মনে চিরকালের জন্য বাসা বেঁধে রইল।
আরো পড়ুন
১। ধর্মঠাকুর ( বাংলার লৌকিক দেবতা)
২। গল্প– স্বর্গপ্রাপ্তি
৩। ওঝার ব্যাটা বনগরু (প্রবাদের উৎস ও অর্থ)